চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ৩১ নম্বর ওয়ার্ডে অগ্নিদগ্ধ মো. বাবুলের পাশে বসেছিলেন মা মর্জিনা বেগম। শনিবার (৪ জুন) রাতে সীতাকুণ্ডের বিএম কনটেইনার ডিপোতে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় বাবুলের শরীরের প্রায় ৫০ শতাংশ পুড়ে গেছে। আছেন জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে। অক্সিজেন লাগানো অবস্থায় বাবুলের পোড়া গায়ের ময়লা পরিষ্কার করছিলেন মর্জিনা আক্তার। আর হাউমাউ করে কেঁদে বলছিলেন, ‘আমার ছেলে পুড়ে গেছে তো কি হয়েছে। আমি বেঁচে থাকতে আমার ছেলের গায়ে নোংরা থাকতে পারবে না।’
অগ্নিদগ্ধদের স্বজনরা এমন আর্তনাদ করছেন চট্টগ্রাম মেডিকেলে। তাদের আহাজারিতে ভারী হয়ে উঠেছে আশপাশের পরিবেশ।
শনিবার বিকালে বাঁশখালীর জলদি এলাকার বাসিন্দা অর্পণ কর ডিপোর ডিউটি শেষে বাসায় চলে যান। কিন্তু ডিপোতে আগুন লাগার কথা শুনে ছুটে যান ঘটনাস্থলে। এর পরপরই বিস্ফোরণে আহত হন অর্পণ। তিনি বোন রুম্পা করকে মুঠোফোনে কল দিয়ে বলেন, ‘আমি বাঁচবো না। আমাকে তাড়াতাড়ি ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাও।’ পরে আহত অবস্থায় চট্টগ্রাম মেডিকেলে অর্পণকে খুঁজে পায় পরিবার।
বাঁশখালীর রতন (৫৮) নামের এক সুপারভাইজার অফিস শেষে কোয়ার্টারে অবস্থান করছিলেন। আগুনের খবর শুনে দেখতে গিয়ে বিস্ফোরণে দগ্ধ হন তিনিও।
এছাড়া রতনের মতো একই পরিণত হয়েছে নোয়াখালীর বাসিন্দা বিধান দে’র।
অগ্নিদগ্ধদের অধিকাংশের চোখ ও শ্বাসনালি পুড়ে গেছে। এদের অনেকের অবস্থা আশঙ্কাজনক। চিকিৎসকরা বলছেন, আহতদের প্রায় ৬০ শতাংশ পর্যন্ত আগুন পুড়ে গেছে। এরমধ্যে চট্টগ্রাম মেডিকেলের ৩৬ নম্বর বার্ন ইউনিট ও ৩১ নম্বর ওয়ার্ডে চিকিৎসাধীন আছেন ৫০ জনের বেশি। বার্ন ইউনিটে আসনসংকট হওয়ায় ৩১ নম্বর ওয়ার্ড এবং ২৪ নম্বর ওয়ার্ডে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে।
সর্বশেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত মৃত্যু হয়েছে ৪৯ জনের। তাদের মধ্যে ১৪ জনের পরিচয় মিলেছে। অন্যদের মধ্যে কয়েকজনের স্বজনরা হাসপাতালে এখনও আসেননি। আবার শরীরের অধিকাংশ পুড়ে যাওয়ায় অনেকের মরদেহ শনাক্ত করার মতো অবস্থায় নেই। ফলে এখনও ৩৫ জনের পরিচয় মেলেনি।
আহত হয়েছেন প্রায় দুই শতাধিক। আহতদের মধ্যে থেকে মৃত্যু সংখ্যা বাড়বে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন চিকিৎসকরা।
রোববার (৫ জুন) দুপুরে বার্ন ইউনিট এবং ৩১ নম্বর ওয়ার্ড গিয়ে দেখা যায়, আহতদের মধ্যে শ্বাসনালি ও চোখ পুড়ে যাওয়াদের সংখ্যা বেশি।
সীতাকুণ্ড দক্ষিণ সলিমপুর গ্রামের দিদারুল আলমের ছেলে তোফাজ্জল আইটি ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে তিন বছর ধরে কাজ করছেন বিএম ডিপোতে। ডিউটি মাগরিবের নামাজের আগে শেষ হয়ে যায়। ডিপোতে আগুন লাগার খবর পেয়ে ফ্যাক্টরিতে চলে যান তিনি। গিয়ে অগ্নিদগ্ধ হন। মাকে ফোন করে বলেন, ‘আমি মারা যাচ্ছি। আমাকে বাঁচাও।’
নোয়াখালীর কোম্পানিগঞ্জের বাসিন্দা ওমর ফারুকের (৩২) চোখ ও হাত পুড়ে গেছে। পোড়া শরীরে হাসপাতালের বেডে অচেতন অবস্থায় শুয়ে আছেন, চোখে ব্যান্ডেজ। এছাড়া দগ্ধ হয়েছেন মানিকছড়ির আনোয়ার হোসেন (১৭)। এরা সবাই বার্ন ইউনিটে চিকিৎসাধীন রয়েছেন।
অন্যদিকে ৩১ নম্বর ওয়ার্ডের আহতদের অবস্থাও একই। অধিকাংশের শ্বাসনালি ও চোখ পুড়ে গেছে।
এই ওয়ার্ডে চিকিৎসাধীন আছেন বিএম ডিপোর হেভী ইকুপমেন্ট অপারেটর মুরাদ হোসেন (৩২)। দু’মাস ধরে তিনি চাকরিতে আছেন। শনিবার রাত থেকে ডিউটি ছিল তার। আগুন লাগার খবর পেয়ে বাইরে এসে ২০০ গজ দূরে দাঁড়ান তিনি। কিন্তু সেখানেই বিস্ফোরণ হয় কনটেইনার। তার মুখ ও পুরো শরীরের বেশির ভাগ অংশ পুড়ে গেছে।
ডিপোতে কনটেইনার চেক করতেন ফেনীর বাসিন্দা নূর আহম্মদ (১৯)। শনিবার রাত থেকে ডিউটি ছিল তার। বিস্ফোরণে অগ্নিদ্বগ্ধ হয়ে অজ্ঞান হয়ে পড়েন তিনি। পরে চোখ মেলে দেখেন চট্টগ্রাম মেডিকেলে তিনি। তার পাশে বসে বাতাস করছিলেন আর চোখের জল মুছে দিচ্ছিলেন নূর আহম্মদের মা।
বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি বিভাগের প্রধান ডা. রফিক উদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘আহতদের শরীরের তিন থেকে ৬০ শতাংশ পুড়ে গেছে। বেশিরভাগ শ্বাসনালি ও চোখ পোড়া রোগী। শ্বাসনালি পুড়ে যাওয়া রোগীদের অবস্থা আশঙ্কাজনক। অগ্নিদগ্ধ রোগী বাড়ার কারণে ৩১ ও ২৪ নম্বর ওয়ার্ডের চিকিৎসা চলছে।’