অনেক শিশু রয়েছে বয়সের সঙ্গে মেধার বিকাশ ঘটে না। সহজ কথায় বলতে গেলে যে বয়সে যা পারার কথা সে বয়সে তা করতে পারে না। রাজধানীর উত্তরায় বাস করেন শাম্মি রহমান। তার একটি সাত বছরের ছেলে রয়েছে। ছেলেটি অন্য বাচ্চাদের তুলনায় একটু দেরিতে কথা বলতে শুরু করেছিল। সে সময় চিকিৎসকেরা বলেন এটা অনেক বাচ্চাদের ক্ষেত্রেই হয়। কিন্তু স্কুলে ভর্তি করানোর পর জানতে পারলেন যে সে অন্য বাচ্চাদের তুলনায় শিখতে অনেক বেশি সময় নেয়।
এ বিষয়ে শাম্মী বলেন, ছেলেটি এতটাই পিছিয়ে যে শিক্ষকদের পরামর্শে তাকে দুই বছর ধরে প্লে-গ্রুপে রাখা হয়েছে। তবে কেন এমন হচ্ছে সে ব্যাপারে তিনি নিশ্চিত নন এবং এ ব্যাপারে কোনো বিশেষজ্ঞের পরামর্শও নেননি তিনি।
এক গৃহশিক্ষক জানান, শেখাতে না পেরে তিনি এক পর্যায়ে চতুর্থ শ্রেণির একটি বাচ্চাকে পড়ানোই ছেড়ে দিয়েছেন।
তিনি বলেন, ছয় মাস ধরে একটা জিনিস পড়ালাম। কিন্তু দেখা যেতো যে সে তারপরও শিখতে পারছে না। তার বাবা একজন অংকের শিক্ষক। দেখা যেতো সকালে সে একটা বিষয় শিখেছে কিন্তু সন্ধ্যায় আর পারছে না। আমি নানা পদ্ধতিতে চেষ্টা করতাম।
ডিসলেক্সিয়া কি?
এমন কি হতে পারে যে এই শিশু দুটির ডিসলেক্সিয়া রয়েছে? ডিসলেক্সিয়া এমন একটি সমস্যা যার কারণে শিশুদের কোনো কিছু শিখতে গিয়ে সমস্যা বা দেরি হয়।
বাংলাদেশে এই জন্মগত ত্রুটি সম্পর্কে তেমন একটা ধারণা নেই। কোনো শিশুর অক্ষর বা ভাষা মনে রাখতে, পড়া বা লেখা শিখতে দেরি হলে খুব সহজেই অভিভাবক বা শিক্ষকেরা বলে ফেলেন যে তার পড়ালেখায় মন নেই – তাই কিছু শিখতে পারছে না।
বাংলাদেশ শিশু হাসপাতাল ও ইন্সটিটিউটের অধ্যাপক ডা. রিয়াজ মোবারক বলেন, গবেষণায় প্রমাণিত যে ডিসলেক্সিয়া একটি জন্মগত ত্রুটি যা শিখন প্রক্রিয়াকে ব্যাহত করে, বিলম্বিত করে। মেধা ও বুদ্ধিমত্তার সাথে এর কোনো সম্পর্ক নেই।
এটি এমন একটি সমস্যা যা এক একটি শিশুর ক্ষেত্রে একেক রকম হতে পারে। কারো হয়ত ভাষা শিখতে দেরি হয়, কারো লিখতে দেরি হয় বা পড়তে দেরি হয়। কোনো শিশুর এর সবগুলোতে আবার কারো যেকোনো একটিতে সমস্যা হতে পারে।
ডিসলেক্সিয়া লক্ষণ
যুক্তরাজ্যের স্বাস্থ্য সেবা সংস্থা এনএইচএস বলছে, একটি শিশুর বেড়ে ওঠার বিভিন্ন পর্যায়ে বিভিন্নভাবে ডিসলেক্সিয়া প্রকাশ পায়। তবে প্রাথমিক স্কুলে একটু বেশি চোখে পড়ে – যেহেতু তখন সে অনেক নতুন কিছু শিখতে শুরু করে।
একই বয়সী অন্য শিশুদের তুলনায় তার কিছু শিখতে দেরি হওয়া এটির প্রধান লক্ষণ। যেমন নতুন কোনো শব্দের উচ্চারণ শিখতে, শব্দের আওয়াজটি ধরতে ও বলতে সমস্যা । অক্ষর লিখতে সমস্যা, কোন অক্ষরটি কোনটির পরে আসে, সপ্তাহের বিভিন্ন দিনের ধারাবাহিকতা মনে রাখার সমস্যা।
বানান শিখতে দেরি হওয়া, একই রকম দুটো শব্দ গুলিয়ে ফেলা, দেখে লিখতেও সময় নেয়া। একই বয়সী অন্য বাচ্চাদের তুলনায় দেরিতে পড়তে ও লিখতে শেখা। একই বয়সী অন্য বাচ্চাদের তুলনায় ধীরে পড়ার গতি ও পড়ার সময় বেশি ভুল করা।
কেন হয়?
ডা. রিয়াজ মোবারক শিশুদের শারীরিক ও মানসিক বৃদ্ধি সম্পর্কিত বিশেষজ্ঞ। তিনি বলেন, এটি একটি জিনগত সমস্যা। তাই পরিবারে অন্য কারো ইতিপূর্বে সমস্যাটি থেকে থাকলে শিশুদের এ ত্রুটি দেখা দেয়ার সম্ভাবনা বেশি থাকে।
প্রতিটি কাজের জন্য মানুষ মস্তিষ্কের বিভিন্ন অংশ ব্যবহার করে। যেমন যে অংশ দেখা, শেখা, লেখায় কাজ করার কথা ডিসলেক্সিয়ায় আক্রান্ত শিশুদের সেই অংশটি সঠিকভাবে কাজ করে না।
তিনি আরও বলেন, এমন শিশুদের ওই বিষয়গুলো শিখতে সমস্যা হয়, দেরি হয়। কিন্তু তার অর্থ এই নয় যে তারা বোকা বা বুদ্ধি-প্রতিবন্ধী। এটি নিয়ে এখনো গবেষণা চলছে। এর নির্দিষ্ট কারণ এখনো পরিষ্কার নয়। সমস্যাটি আরও ভালো করে বুঝতে একজন বিশেষজ্ঞের কাছে যাওয়ার পরামর্শ দিচ্ছেন তিনি।
করণীয় কী?
মনোরোগ বিশেষজ্ঞ ডা. মেখলা সরকার বলেন, এসব শিশুরা সাধারণত পড়াশোনায় অন্যদের চেয়ে পিছিয়ে থাকে। সঠিক সময়ে ধরতে না পারলে তারা আরও বেশি পিছিয়ে যায়।
এক্ষেত্রে তার পরামর্শ হচ্ছে, “ডিসলেক্সিক শিশু পিছিয়ে আছে বলে তাকে অন্য শিশুর সাথে তুলনা করা যাবে না, তাকে বকাঝকা করা যাবে না তাহলে সে নিজের ক্ষমতার ব্যাপারে অনেক বেশি সন্দেহ করতে শুরু করবে এবং তাতে শিখতে আরও সমস্যা হবে। আর মারধরতো করাই যাবে না। তাহলে সে লেখাপড়াকে ভয় পেতে শুরু করবে।
তিনি বলেন, এই শিশুদের ক্ষেত্রে অভিভাবক ও শিক্ষকের অনেক বেশি ধৈর্য দরকার হয়। ধৈর্য সহকারে তাকে যত্ন না নিলে তার শিক্ষা ও জীবন দীর্ঘ মেয়াদে প্রভাবিত হয়।
তিনি আরও বলেন, এক্ষেত্রে স্কুলের সাথে অভিভাবকদের অনেক সমন্বয় দরকার। ডিসলেক্সিক শিশুদের জন্য আলাদা স্কুল প্রয়োজন আছে বলে মনে করেন না তিনি। তবে তাদের অন্য শিক্ষার্থীদের চেয়ে অবশ্যই বেশি সময় ও মনোযোগ দিতে হবে।
বাংলাদেশে এর প্রভাব কতটুকু সে বিষয়ে ঢাকার একটি প্রাথমিক স্কুলের শিক্ষক আনিতা দাস বলেন, এখন শিক্ষকদের প্রশিক্ষণের অংশই থাকে যে আমরা একটা বেসলাইন সার্ভে করি। দুর্বল শিশু, কার ক্ষমতা কতটুকু, কে কোনটাতে ভাল, কোন শিশুর কোন বিষয়ে চাহিদা বেশি এসব জানার জন্য। এটা করে আমরা তাদের সেইভাবে শিখন পদ্ধতিতে সহায়তা করার চেষ্টা করি। কিন্তু স্কুলের অনেক ভূমিকা থাকলেও আমাদের দেশে এক একটি ক্লাসে অনেক বেশি বাচ্চা, সেই তুলনায় শিক্ষক এত কম যে তাদের সবার দুর্বলতা অত বিস্তৃতভাবে চিহ্নিত করার সুযোগ আসলে আমাদের নেই। যার ফলে এক পর্যায়ে এমন অনেক শিশু ঝড়ে পড়ে। বিশেষ করে মেয়েদের তাড়াতাড়ি বিয়ে দিয়ে দেয়া হয় এবং ছেলেদের কাজে পাঠানো হয়।